ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব, আবেদনের শর্ত এবং প্রক্রিয়া
ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব, আবেদনের শর্ত এবং প্রক্রিয়া
পৃথিবীর সবচাইতে সুখী দেশ হিসেবে পরিচিত ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্বের সুযোগ কে না নিতে চায়? তাইতো প্রতিবছর যারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে ফিনল্যান্ডে কাজ বা অন্যান্য উদ্দেশ্য নিয়ে যায় তাদের মধ্যে প্রায় সবাই চিন্তা করে কিভাবে সেখানকার নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। যেহেতু ফিনল্যান্ড একটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং সেনজেন ভুক্ত দেশ তাই সেখানকার নাগরিকত্ব পেলে আপনি শুধু ফিনল্যান্ড নয় বরং ইউরোপের সেনজেন ভুক্ত যে আরো ২৬ টি দেশ রয়েছে সেখানেও কোন প্রকার ভিসা ছাড়া যাতায়াত করতে পারবেন। সবচেয়ে সুখী দেশের পাশাপাশি ফিনল্যান্ড জীবনযাত্রার মান, সামাজিক সুরক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষার জন্যও পৃথিবীব্যাপী সুপরিচিত। তবে চলুন ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে আপনাকে কি কি শর্ত পূরণ করতে হবে এবং আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
নাগরিকত্ব পাওয়ার শর্ত সমূহ
আবাসিকতার শর্ত
আপনি যে কোন উদ্দেশ্যে ফিনল্যান্ডে যান না কেন নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আপনাকে মিনিমাম ৫ বছর সেখানে থাকতে হবে। অর্থাৎ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার ক্ষেত্রে আপনাকে মিনিমাম ফিনল্যান্ডে ৫ বছর স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হবে। তবে আপনি যদি ফিনল্যান্ডের কোন নাগরিকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তাহলে সেক্ষেত্রে এই সময়সীমা কিছুটা কমে আসতে পারে। এছাড়া আপনি যদি সেখানে মানবিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন সেক্ষেত্রেও এই সময়সীমা কিছুটা কমতে পারে।
ভাষাগত দক্ষতা
ফিনল্যান্ডে সাধারণত দুইটি ভাষা প্রচলিত আছে একটি হলো ফিনিশ অপরটি হলো সুইডিশ। আপনি যদি ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেতে চান তাহলে এর মধ্যে একটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে। শুধু তাই নয় ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার আগে আপনাকে সরকারিভাবে অনুষ্ঠিত একটি ভাষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
চারিত্রিক গুণাবলি
নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে আপনার উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট অর্থাৎ কোনরকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করা নিয়মিত ট্যাক্স পরিষোধ এবং অন্যান্য সামাজিক কর্মকান্ডে গুলাতে অংশগ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হয়ে থাকে। আপনি তাদের দেশ সম্পর্কে কতটুকু আন্তরিক সে বিষয়টা এখানে মুখ্য। অর্থাৎ আপনাকে যে মিনিমাম পাঁচ বছর সেখানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে হবে সে সময়টাতে দেশটির সমস্ত নিয়ম কানুন যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে।
আয়ের উৎস
বসবাস কালীন সময়ে আপনি যে প্রেশার সাথে যুক্ত ছিলেন সেটি অবশ্যই আপনার জীবনযাত্রার খরচ বহনের জন্য যথেষ্ট হতে হবে। সহজ ভাবে বলতে গেলে ফিনল্যান্ডে একজন মানুষের বসবাস করতে দৈনন্দিন যে খরচ করতে হয় সেগুলো বহন করার জন্য আপনার উপযুক্ত একটি কর্মসংস্থান থাকতে হবে।
বয়সসীমা
নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের আগে অবশ্যই আবেদনকারীকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে অর্থাৎ নূন্যতম বয়স ১৮ বা তার বেশি হতে হবে। তবে যদি পিতা-মাতা বা অভিভাবক হিসেবে অন্য কারো নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে বয়সসীমা আঠারোর কম হলে অসুবিধা নেই।
বিশেষ বিবেচনা
কেউ যদি ফিনল্যান্ডে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চায় তাহলে সেক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় তাকে নাগরিকত্ব দেয়া হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে নাগরিকত্বের যে সাধারণ নিয়ম কানুন গুলো রয়েছে সেগুলোর কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।
নাগরিকত্বের শপথ
আপনি যদি ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার পর তারা আপনার আবেদনপত্র দেখে যোগ্য মনে করে তাহলে আপনাকে নাগরিকত্ব প্রদান করবে। আপনি যখন নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন তখন দেশটির যে সংস্কৃতি এবং নিয়ম কানুন গুলো রয়েছে সেগুলোর উপরে শ্রদ্ধা রেখে আপনাকে নাগরিকত্বের জন্য শপথ গ্রহণ করতে হবে। এটা মূলত এখনকার আনুষ্ঠানিক একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আপনার তাদের দেশ সম্পর্কে শ্রদ্ধা বা ভক্তি কতটুকু সেটি যাচাই করা হয়।
দ্বৈত নাগরিকত্ব
দ্বৈত নাগরিকত্ব বলতে দুটি দেশের নাগরিক থাকাকে বোঝায়। অর্থাৎ আপনি যদি বাংলাদেশের নাগরিক থাকা অবস্থায় ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন তাহলে সে ক্ষেত্রে আপনাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করতে হবে না দুটি দেশের নাগরিকত্ব আপনি একই সাথে বহন করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশে দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমোদন আছে কিনা এটি একটি বিবেচ্য বিষয়। যদি বাংলাদেশ সরকার আপনাকে দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমোদন দেয় তাহলে আপনি একই সাথে ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারবেন।
নাগরিকত্ব বাতিলের সম্ভাবনা
নাগরিকত্ব পাওয়ার পরেও বিশেষ কিছু কারণে সেটা বাতিল হতে পারে যেমন আপনি যদি মিথ্যা কোন তথ্য দিয়ে নাগরিকত্ব পান সেক্ষেত্রে সেটি বাতিল হতে পারে। এছাড়া নাগরিকত্ব পাওয়ার পর যদি আপনি সে দেশের আইন বিরোধী কোনো কর্মকান্ডে জড়িত হন সে ক্ষেত্রে আপনার নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব যেকোনো সময় বাতিলের অধিকার সে দেশের সরকার রাখে। তাই নাগরিকত্ব পাওয়ার পর আপনাকে সতর্কতার সাথে সে দেশের সমস্ত নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাওয়ার মাধ্যমে আপনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সেনজেনভুক্ত যে দেশগুলো রয়েছে সেগুলোতে কোন প্রকার ভিসা ছাড়াই যাতায়াত করতে পারবেন।
নাগরিকত্বের আবেদন প্রক্রিয়া
আবেদনপত্র জমা দেয়া
সর্বপ্রথম আপনাকে অনলাইনের মাধ্যমে একটি নাগরিকত্বের আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি সরাসরি Finnish Immigration Service (Migri) এর অফিসে গিয়ে আবেদন পত্র সংগ্রহ করে জমা দিতে পারেন অথবা আপনি যদি চান তাহলে তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন ফরম পূরণ করে জমা দিতে পারবেন।
আবেদন ফি প্রদান
আবেদন ফরম সংগ্রহ করে পূরণ করার পর আপনাকে তাদের নির্ধারিত ফি জমা দিতে হবে। আবেদনের ফি এর পরিমাণ ঠিক কত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে বলা যায় না যখন আবেদন করবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থেকে জেনে নেবেন। তবে অনলাইনে এবং অফলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদন ফি এর পরিমাণ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে।
আবেদন যাচাই
আপনি যখন নির্ধারিত ফি এর সাথে আবেদন ফরমটি পূরণ করে জমা দিবেন এরপরে দেশটির কর্তৃপক্ষ আপনার আবেদনটি যাচাই-বাছাই করবে। আপনার কর্মসংস্থান, কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আছে কিনা, আপনার সামাজিক দায়বদ্ধতা কতটুকু পালন করেছেন, আপনি তাদের স্থানীয় ভাষা শিক্ষার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন কি না, আপনি সঠিকভাবে আয়কর পরিশোধ করেন কিনা এই বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে তারা সিদ্ধান্ত নিবেন আপনাকে নাগরিকত্ব দেয়া হবে কি না। সবকিছু বিবেচনা করার পর আপনি যদি যোগ্য হন তাহলে আপনি ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন।
ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্বের সুবিধা
ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাওয়ার সবচাইতে বড় সুবিধা হিসেবে যদি বিবেচিত হয় সেটি হল আপনি সেনসেনভুক্ত দেশগুলোতে কোন প্রকার ভিসা ছাড়াই যাতায়াত করতে পারবেন। শুধু তাই নয় সেনযেন ভুক্ত দেশগুলোতে টেম্পোরারি অথবা পার্মানেন্টলি থাকার অনুমতি পাবেন। আপনি যদি চান তাহলে সেখানে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজও করতে পারবেন।
আপনি যখন ফ্রিল্যান্ডের নাগরিকত্ব পাবেন তখন সেখানকার নির্বাচনগুলোতে ভোটও দিতে পারবেন। অন্যদিকে সরকারি চাকরির সুবিধা তো থাকছেই। আপনি যতদিন না সেখানকার নাগরিক হচ্ছেন ততদিন পর্যন্ত আপনি সরকারি চাকরির সুবিধা পাবেন না আপনাকে বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হবে। অর্থাৎ নাগরিকত্বের মাধ্যমে আপনি ফিনল্যান্ডের সরকারি চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন যেটি শুধুমাত্র সেখানকার নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত।
নাগরিকত্ব পাওয়ার পর আপনি যদি চান তাহলে আপনার ফ্যামিলি মেম্বারদের ফিনল্যান্ডে ঘোরার উদ্দেশ্যে অথবা স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্য নিয়ে আসতে পারবেন। এছাড়া ফিনল্যান্ডে অবস্থানকালীন সময়ে যে কোন সমস্যায় আপনি সেখানকার দূতাবাস থেকে আইনি সহায়তা পাবেন।
ফিনল্যান্ডের একজন নাগরিক যেসব সুযোগ সুবিধা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করেন আপনিও ঠিক একই রকম সুযোগ-সুবিধা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করতে পারবেন। তাছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে পেনশন এবং অন্যান্য যে সুবিধা গুলো রয়েছে সেগুলো আপনি পাবেন।
শেষ কথা
ফিনল্যান্ডে নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়াটা যেহেতু একটু জটিল এবং সময় সাপেক্ষ তাই এক্ষেত্রে অন্তত ছয় মাস থেকে শুরু করে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। মূলত আপনার আবেদন পত্র টি যাচাই-বাছাই করার জন্য এই সময়টির প্রয়োজন হয়। তবে আনুমানিকভাবে বলা যায় নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে সেসব পুরোপুরি সম্পন্ন হতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় লাগবে।
আমাদের ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন; প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url