ভিয়েতনামের দর্শনীয় স্থান,যুদ্ধ,ইতিহাস এবং সংস্কৃতি
ভিয়েতনামের দর্শনীয় স্থান,যুদ্ধ,ইতিহাস এবং সংস্কৃতি
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একদম পূর্ব দিকে অবস্থিত বলে এর আরেক নাম ইন্দো-চীন। ভিয়েতনাম ইতিহাসে রক্তাক্ত গণহত্যার জন্য পরিচিত। তবে দেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতি এবং চমকপ্রদ বিভিন্ন প্রকার খাবারের কথা বলে শেষ করা যাবে না। আজকে আমরা ভিয়েতনাম সম্পর্কে মজার মজার এবং অবাক করা কিছু বিষয় জানবো।ভিয়েতনাম নামকরনের ইতিহাস
ভিয়েতনাম একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ,দেশটির রাষ্ট্রীয় নাম সোসালিস্ট রিপাবলিক ভিয়েতনাম তবে দৃষ্টি পৃথিবীব্যাপী শুধু ভিয়েতনাম নামে পরিচিত। এই দেশটির নামকরণের পেছনে রয়েছে মজাদার একটি গল্প। প্রাচীন ভিয়েতনামের ভাষায় অর্থ পরি অথবা ড্রাগন এখানকার মানুষ নিজেদেরকে ড্রাগন এবং পরীর বংশধর মনে করে বলেই দেশটির নাম রাখা হয়েছে ভিয়েতনাম। দেশটির আয়তন ৩ লক্ষ ৩১ হাজার ২১২ বর্গ কিলোমিটার এবং দৃষ্টির বর্তমান জনসংখ্যা ৯ কোটি ৯0 লাখের মতো। ভিয়েতনাম পৃথিবীর মধ্যে 15 তম জন্মবহুল দেশ হিসেবে পরিচিত।ভিয়েতনামের কিছু মজাদার ব্যাপার
ভিয়েতনামের বসবাসকারী মানুষের কি মজাদার বৈশিষ্ট্য হলো তারা প্রচন্ড পরিমাণে মোটরসাইকেল প্রেমি। হিসাব করে দেখা গিয়েছে তাদের মাথাপিছু দুইজনের জন্য একটি করে মোটরসাইকেল রয়েছে যেটি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।এছাড়াও ভিয়েতনামে রয়েছে হুংলোক নামক জমজ শিশুদের গ্রাম যেখানে প্রচুর পরিমাণে জমজ শিশুর জন্ম হয়ে থাকে। বেশিরভাগ জমজ হওয়ায় তাদের বিয়ে হয় যমজ জুটির সাথে। এই অঞ্চলে এত পরিমান জমজ শিশুর জন্ম হওয়ার পিছনে কারণ হিসেবে গণ্য করা হয় সেখানকার খাবার পানিতে থাকা যে ধরনের রাসায়নিক পদার্থকে কে ।
ভিয়েতনামের পর্যটন স্থানসমূহ
ভিয়েতনাম জনবহুল দেশ হলেও এখানে কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব নেই। পর্যটকদের জন্য ভিয়েতনামে ৩৪টি ন্যাশনাল পার্ক রয়েছে এগুলোর মধ্যে কুক ফুং জাতীয় উদ্যান বিভিন্ন প্রকার বৈচিত্র্যময় প্রাণীর জন্য বিখ্যাত। এই পার্কটি তে বাঘ, হা্তি, ভাল্লুক, হাতি ইত্যাদি বড় বড় প্রাণীর পাশাপাশি রয়েছে ৪০০ প্রকারের পাখি। এ ছাড়া পার্কের মধ্যে 6600 ফিট উঁচু করডোমাম পর্বতমালার কিছু অংশ রয়েছে যেখানে পর্যটকেরা চাইলে হাইকিং এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।ভিয়েতনামের আরেকটি বিখ্যাত পার্ক হলো ফং এনহা কে ব্যাং ন্যাশনাল পার্ক। এই পার্কটির মধ্যে অবস্থিত সং ডুং গোহাটি বিশ্বের বৃহত্তম গোহা হিসেবে বিবেচিত হয়। এই গুহাটির ভেতরে একটি নদী রয়েছে এবং এর বিশালতা এমন যে ধারণা করা হয় এর মধ্যে দিয়ে একটি উড়োজাহাজ অনায়াসে চলাচল করতে পারবে।
হা লং বে ভিয়েতনামের একটি উপসাগর যেটি পৃথিবীর একটি অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময়। পান্নার মত সবুজ পানি এবং ঘন জঙ্গলে ঘেরা চুনাপাথর স্তুপ দ্বীপের জন্য এই উপসাগর পৃথিবীব্যাপী সুপরিচিত। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো হা লং বে উপসাগরটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আরেকটি অবাক করা বিষয় কি জানেন এখানে বসবাসকারী মানুষের চাইতে সংখ্যা বেশি।
এই উপসাগরটির প্রায় দুই হাজারের মতো দ্বীপ রয়েছে যেখানে সমস্ত দ্বীপের বাসিন্দা মিলে মোট ১৬০০ জন মত হবে। তবে এর মধ্যে সব দিপেই মানুষ থাকতে পারে এমন না কিন্তু হা লং বেক্তিতে মানুষের বসবাস রয়েছে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এটি অনন্য। এখানকার দ্বীপগুলোতে বানর,,পাখি, সরীসৃ্প ইত্যাদি প্রজাতির প্রাণীর দেখা মেলে। তাই কেউ ভিয়েতনামে বেড়াতে আসলে অবশ্যই হা লং বে তে আসতে ভোলে না।
একটি কারাগার তৈরি করেছিলো, তবে দ্বীপটি বর্তমানে বিখ্যাত বিশ্বের দীর্ঘতম ক্যাবল কারের জন্য। এই ক্যাবল কারে চড়ে পুরো দ্বীপটি ঘুরে দেখতে মাত্র ৩০ মিনিট সময় লাগবে।
ভিয়েতনামের বৃহত্তম দ্বীপ
ভিয়েতনামের বৃহত্তম দ্বীপ হলো ফু কুত্তক দ্বীপ। এই দ্বীপে ফরাসিরা ভিয়েতনাম যুদ্ধে বন্দী সৈন্যদের রাখার জন্যএকটি কারাগার তৈরি করেছিলো, তবে দ্বীপটি বর্তমানে বিখ্যাত বিশ্বের দীর্ঘতম ক্যাবল কারের জন্য। এই ক্যাবল কারে চড়ে পুরো দ্বীপটি ঘুরে দেখতে মাত্র ৩০ মিনিট সময় লাগবে।
ভিয়েতনামের জলপ্রপাত
ভিয়েতনামে যেমন অসংখ্য দ্বীপ রয়েছে তেমনি রয়েছে অসংখ্য জলপ্রপাত ও। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং চোখ ধাধানো, মনমাতানো সৌন্দর্যে ভরা জলপ্রপাত টি হলো ব্যান গিওক জলপ্রপাত। এটি এশিয়ার সর্ব বৃহত এবং সারা বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ। বলা হয়ে থাকে কোনো ব্যক্তি কে নিজের মতো করে একটা জলপ্রপাত তৈরি করার সুযোগ দিলে সে অবশ্যই ব্যান গিওক জলপ্রপাত এর মতো একটা জলপ্রপাত তৈরি করতো। পর্যটকেরা যখন নৌকা নিয়ে জলপ্রপাতের কাছাকাছি যায় তখন তারা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করতে পারে।ভিয়েতনামের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বিকৃতী প্রাপ্ত শহর
ভিয়েতনামের মোট ৭ টি স্থান কে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বিকৃতী দিয়েছে ইউনেস্কো তার মধ্যে রয়েছে ভিয়েতনামের প্রাচীন শহর হই এন। এই শহরটি ভিয়েতনামের প্রাচীন সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য ধারণ করে। হইয়েন শহরটি ঘুরতে আসলে প্রথমেই চোখে পড়বে আইকনিক জাপানিজ কভার্ড ব্রিজ। এই ব্রিজের মাঝে রয়েছে ছোট একটা মন্দির এছাড়াও ব্রিজটি অনেকগুলো বানর এবং কুকুরের মূর্তি দিয়ে সাজানো। হই এন শহর পুরোটাই যেনো একটা জাদুঘর আর এই শহরের বাজার থেকে পর্যটকেরা কিনতে পারবেন ভিয়েতনামের আদীম আদিবাসী দের তৈরি প্রাচীন সব জিনিসপত্র। এই শহরটি ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা হতে পারে আপনার স্বপ্নের মতো সুন্দর।ভিয়েতনামের অদ্ভুত ব্রিজ
ভিয়েতনামে একটি অদ্ভুত ব্রিজ রয়েছে যা গোল্ডেন ব্রিজ নামে পরিচিত। অদ্ভুত বিষয় হলো এটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যেটি দেখে মনে হবে দুটি দৈত্তাকার হাত যেনো ব্রিজটিকে ধরে রেখেছে। ৪৯০ ফিট দৈর্ঘ বিশিষ্ট এই ব্রিজটি পথচারীদের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হয়।ভিয়েতনামের যুদ্ধ থেকে তৈরি কিছু দর্শনীয় স্থান
যুদ্ধ যেকোনো দেশকে ধ্বংশ করে দেয় তবে যুদ্ধ ভিয়েতনামকে দিয়ে গেছে কিছু পর্যটন স্থান। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট ভিয়েতকং আর্মি আমেরিকান বাহিনি কে আক্রমণ করার জন্য কয়েক মাইল দীর্ঘ একটু সুরঙ্গ খুড়েছিলো। চু চি নামের এই সুরঙ্গটিকে বর্তমানে ভিয়েতনামিরা একটি পর্যটন স্থানে রূপান্তরিত করেছে। পর্যটকেরা এই সুরঙ্গে ঢুকে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং চাইলে অর্থের বিনিময়ে অর্থের বিনিময়ে একে ৪৭ রাইফেল দিয়ে গুলিও চালাতে পারেন এভাবে ভিয়েতনামিরা তাদের যুদ্ধকে এবং যুদ্ধে শহীদদের কষ্টকে এখনো লালন করছে তাদের চলমান সংস্কৃতি তে।
ভিয়েতনামের খাদ্য সংস্কৃতি
ভিয়েতনামের পর্যটন স্থান গুলো যেমন রুপকথার মতো সুন্দর তেমনি এদেশের খাদ্য সংস্কৃতি ও অনেক সৃষ্টিশীল এবং অবাক হওয়ার মতোই। এদেশের রন্ধন প্রনালিতে প্রচুর ভেষজ উদ্ভিদ এবং মশলা ব্যবহার করা হয়। ভিয়েতনামেত জাতীয় খাবার হলো 'ফো' নামের এক ধরনের মাংসের স্ট্রু।
ব্রাজিলের পর ভিয়েতনাম সবথেকে বেশি কফি রপ্তানি করে থাকে। ঘরে বাহিরে প্রায় সর্বত্রই দেশটির আদিবাসী রা কফি পান করতে পছন্দ করে। মজার বিষয় হলো ভিয়েতনামে ডিম কফি নামে একটি অদ্ভুত রকমের কফির প্রচলন রয়েছে,এটি তৈরিতে কনডেন্স মিল্ক এবং ডিমের কুসুম ব্যবহার হয়। এমনকি এদেশে নারিকেল কফি নামে আরো এক ধরনের কফি পাওয়া যায়।
শুধু কফি নয় মদ তৈরির ক্ষেত্রে মানুষেরা আরো অদ্ভুত, পুরো বিশ্ব যখন আলু অথবা চিনি দয়ে ভদকা তৈরি করছে অন্যদিকে ভিয়েতনামের মানুষেরা তখন সাপ দিয়ে তৈরি করছে ভদকা। রু রান নামে পরিচিত এই সাপের ভদকা ভিয়েতনামে ব্যপক পরিচিত এবং জনপ্রিয়। ভিয়েতনামিরা বিশ্বাস করে সাপের মাংস তারুন্য ধরে রাখতে সাহায্য করে আর এলকোহল সাপের বিষের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয় তাই মদ পানে কোনো প্রকার ঝুকি নেই।
ভিয়েতনামের সংস্কৃতি
এদেশের সংস্কৃতি বেশ বৈচিত্রময়, ভিয়েতনামের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ কোনো রকমের ধর্ম পালন না করলেও বেশিরভাগই লোকবিশ্বাসের ঐতিহ্য পালন করে। এখানকার একটি ঐঐতিহ্যবাহী উৎসব হলো জলের পুতুল নাচ। মঞ্চের উপরে কাঠের কাঠের পুতুল দিয়ে বিভিন্ন গল্প অভিনয় করে দেখানো হয়, এই পুতুল নাচ দেখাতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। কারন প্রথমত পুতুল গুলোর ওজন প্রায় ৫ কেজি, উচ্চতা ১০০ সে.মি অবই হতে পারে আর পানিতে এই নাচ দেখাতে প্রচুর শক্তি ব্যয় করতে হয় সঞ্চালকদের। ভিয়েতনামের নববর্ষ পুরো দেশ জুরে পালন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, মজার বিষয় হলো সমগ্র বিশ্ব জানুয়ারি মাসে নববর্ষ পালন করলেও এদেশে পালন করা হয় ফেব্রুয়ারী মাসে। কারন ভিয়েতনাম গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বদলে চন্দ্র ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে বছর গননা করে। ভিয়েতনামিরা বিবাহ উৎসব ও অনেক আনন্দের সাথে মিলেমিশে পালন করে তবে বিবাহ উৎসবে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো কনের লাল জামা, লাল জামা ছাড়া কনেরা বিবাহ না করার কারন লাল রঙ এদেশের সুখের প্রতিক।
ভিয়েতনামের যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস
ভিয়েতনামের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও খাবার বৈচিত্রময় হলেও এদেশের একটি রক্তক্ষয়ী ইতিহাস রয়েছে। আর এই রক্তক্ষয়ী ইতিহাসে যে মানুষটি ভিয়েতনামের সুপারম্যান হিসেবে মানুষের মনে গেথে আছেন তিনি হলেন হো চি মিন। তিনি ভিয়েতনামের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন এবং ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ ভিয়েতনাম প্রতিষ্ঠিত করেন। এছাড়াও ২০ শতকের প্রথম দিকে হো চি মিন ভিয়েতনামের জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিস্ট আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দখলদার জাপানি বাহিনির বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তী তে প্রথম ইন্দোচিন যুদ্ধেও তার নেতৃত্বে ভিয়েতনাম ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।হো চি মিনের নেতৃত্ব এবং অঙ্গিরার তাকে ভিয়েতনামের স্বাধীনতার প্রতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তবে এখানেই শেষ নয় দেশটি ভিয়েতনাম আমেরিকা যুদ্ধ নামে ২০ বছর ধরে চলা একটা ভয়াবহ যুদ্ধের সাক্ষি। এই যুদ্ধে ৩ কোটি ভিয়েতনামি এবং ৭ হাজার আমেরিকান প্রান হারিয়েছিলো, এই যুদ্ধকে গনহত্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ভিয়েতনামের ওপর এই অন্যায় যুদ্ধ চালানোর জন্য পুরো বিশ্ব আমেরিকা কে ধিক্কার জানায়। যুদ্ধে ভিয়েতনামের ওপর বৃষ্টির মতো বোমা বিষ্ফোরন করা হয়। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান হয় তবে এখনো আনুমানিক ৮ লক্ষ টন অবিষ্ফোরিত বোমা সারা দেশ জুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
আমাদের ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন; প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url