ডেনমার্কের ইতিহাস,রাজধানী, আয়তন সম্পর্কে জানুন
ডেনমার্কের ইতিহাস,রাজধানী, আয়তন সম্পর্কে জানুন
ডেনমার্ক, উত্তর- পশ্চিম ইউরোপের একটি ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্র। ছোট হলেও এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী, সুখী ও দুর্নীতিমুক্ত দেশগুলোর একটি। একসময় দেশটির রাজারা নরওয়ে ও সুইডেন শাসন করেছেন। বর্তমানে তাদেরকে স্কান্ডিনেভিয়ান দেশ বলা হয়। আজকে আমরা ডেনমার্ক সম্পর্কে জানা অজানা তথ্যই জানবো।
ইতিহাস
ইতিহাসবিদ দের মতে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার বছর আগে ভাইকিংস রা এখানে ডেনিও রাজ্য প্রতিষ্টা করে এরপর প্রায় ৭০০ বছর বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও শাসক দ্বারা দেশটি শাসিত হয়েছে৷ তবে ১৯ শতক থেকে ডেনমার্কের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। তখন থেকেই দেশটির রাজা কেবল একটি অলংকারিক পদ, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শাসিত হলেও ডেনিশ রা তাদের রাজ বংশকে অনেক সম্মান করে। তাদের বর্তমান রাণীর নাম দ্বিতীয় ম্যাক্রেট।
পতাকা
ডেনমার্কের পতকাটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচিন পতাকা গুলোর একটি।ডেন বর্গ নামে পরিচিত এই পতাকাটি ১২১৯ সালে প্রথম ব্যবহৃত হয় একটি যুদ্ধে। পতাকাটি জনপ্রিয় হলে ১৬২৫ সালে এটিকে জাতীয় পরে পতাকা হিসেবে গ্রহন করা হয়।
আয়তন
ডেনমার্কের মোট আতন ৪২ হাজার ৯৫১ বর্গকিলোমিটার। ডেনমার্ক এ রয়েছে মোট 443 টি দ্বীপ যার মধ্যে 76 টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। এই দ্বীপ গুলোর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম একক দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড। গ্রীনল্যান্ড একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল যার বৈদেশিক নীতি ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ডেনমার্ক পালন করলেও গ্রিনল্যান্ডের অন্যান্য সিদ্ধান্ত সেখানকার স্থানীয় সরকার ই নিতে পারে।
রাজধানী
ডেনমার্কের রাজধানীর নাম কোপেন হেগেন যেটি ডেনমার্কের ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণও বটে। শহরটি ড্যানিশ সংস্কৃতি, খাবা্র এবং রাতের জীবন উপভোগ করার জন্য একটি দুর্দান্ত স্থান। কোপেন হেগেনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপত্য হচ্ছে লিটল মারমিড মূর্তি। এটি ডেনমার্কের বিখ্যাত রূপকথা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্থাপন করা চার ফুট এক ইঞ্চি লম্বা এবং ১৭৫ পাউন্ড ওজনের একটি ভাস্কর্য। ১৯১৩ সালে নির্মিত এই লিটল মারমিড একটি বৃহৎ জলাধারের পাশে স্থাপন করা হয়েছে।
এই শহরের আরেকটি বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক হলো টিভোলি গার্ডেন যেটি একটি পূর্ণাঙ্গ থিম পার্ক যেখানে রোলার কোস্টার, গোল চত্বর, বাগান, পুতুল থিয়েটার থেকে শুরু করে রেস্তোরা, ক্যাফে, খাবারের প্যাভিলিয়ন এমনকি একটি কনসার্ট হল ও রয়েছে। ১৮৪৫ সালে নির্মিত এই পার্ক শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়।
ভাষা ও জনসংখ্যা
ডেনমার্কের জনগণ ডেনিশ নামে সারা পৃথিবীব্যাপী পরিচিত। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৫৯ লাখের মতো। তাদের মূল ভাষা ডেনিস হলেও বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত রয়েছে। সরকারিভাবে এদেশের জনগণ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষা এবং চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকেন। ধনী মধ্যবিত্ত বা গরিব সবার ক্ষেত্রেই সাম্যের নীতি অনুসরণ করে শিক্ষা এবং চিকিৎসা সেবা সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে দেয়া হয়।
ডেনমার্কের মানুষজন আইন-কানুনের ব্যাপারে বেশ যত্নশীল তারা খুব নিষ্ঠার সাথে সেই দেশের আইন-কানুন স্বেচ্ছায় পালন করে থাকেন। রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে তারা ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে শৃঙ্খলার সাথে চলাফেরা করে। যদি রাস্তা একেবারে ফাঁকা ও থাকে তবুও তারা ট্রাফিক সিগনাল অমান্য করে না। তবে ডেনিশরা মূলত বাইসাইকেল চালাতে খুব পছন্দ করে,সেজন্যই তো মজা করে বলা হয় ডেনমার্কে মানুষের চাইতে সাইকেলের সংখ্যা বেশি।
তবে ডেনমার্কের একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে দেশটিতে কেউ যদি ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকে তাহলে সেই ব্যক্তির ২৫ তম জন্মদিনে তার দিকে দারুচিনি ছুড়ে মারা হয়।
খাদ্যভ্যাস
ডেনিস রা খেতে প্রচুর পছন্দ করে, স্মোরে বোট নামে এক ধরনের খোলা স্যান্ডউইচ আছে যেটি তারা অনেক পছন্দ করে থাকে। এই স্যান্ডউইচ মূলত একটি পাউরুটির উপরে চিজ, মাখন, সবজি সহ নানা উপাদান দিয়ে পরিবেশিত হয়। দেশটির প্রত্যেকটা রেস্টুরেন্টেই পাওয়া যায় আলাদা আলাদা স্বাদের স্মোরে বোট। শুকরের তৈরি মিট বল ডেনমার্ক জুড়ে খাওয়া হয় যদিও খাবারটি মূলত জার্মানির তবে এদেশে এটি অনেক জনপ্রিয়। মাংসের পাশাপাশি ডেনিশরা মদ্যপান করতেও অনেক ভালোবাসে। তাদের কার্ল্সবার্গ কোম্পানির বেয়ার সারা পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত। প্রায় দেড়শ বছর যাবত এই কোম্পানি ডেনিসদের মদের চাহিদা পূরণ করে আসছে। ডেনমার্ক বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মদ্যপান করা দেশগুলোর মধ্যে একটি এমনকি অপ্রাপ্তবয়সীদের জন্যও মদপানে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
লাইফস্টাইল
ডেনিশদের একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা কোন ব্যাপারে কাউকে অনুরোধ করতে পছন্দ করে না তাই তাদের ডিকশনারিতে স্যরি শব্দটি নেই। ডেনিশরা তাদের জীবনের ছোট ছোট বিষয়গুলোকে অনেক উপভোগ করে। খারাপ আবহাওয়াতে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে তারা এক কাপ কফি এবং সাথে বই পড়াকে উপভোগ্য বলে মনে করে। দেশটির জাতীয় খেলা ফুটবল এবং তারা এটিকে অনেক উপভোগ করে। আপনি হয়তো জানলে অবাক হবেন দেশটি তে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৬০০ টির মত ফুটবল ক্লাব যেখানে ৩ লাখ ২০ হাজারের অধিক নিবন্ধিত প্লেয়ার রয়েছে। তাদের ফুটবল দল ১৯৯২ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল।
আরেকটি চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে দেশটির সরকার সেই দেশে জন্ম নেয়া শিশুদের জন্য প্রায় ৭০ হাজারের মতো নাম ঠিক করে রেখেছে এর বাইরে চাইলেও কেউ আর নাম রাখতে পারবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো আর এমন রাষ্ট্র দ্বিতীয় টি নেই যেখানে বাচ্চাদের নাম রাখা অবদি সরকার অবদান রাখতে চায়। এদেশের মানুষদেরকে যৌনতার দিক দিয়ে মুক্ত বলে মনে করা হয়, এটিই প্রথম দেশ যারা 1969 সালে পর্নোগ্রাফিকে আইন করে বৈধতা দান করেছে। এদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল অবদিও বিভিন্ন পর্নোগ্রাফি সম্প্রচার করে থাকে। এসব কিছু অদ্ভুত ব্যাপারের কারণে পর্যটকদের দেশটি সম্পর্কে অনেক বেশি আগ্রহ জন্মায়।
পর্যটন কেন্দ্রসমূহ
অন্যান্য আরো অনেক আকর্ষণীয় ব্যাপার থাকলেও এ দেশটির মূল আকর্ষণ হচ্ছে বিভিন্ন আকর্ষণীয় এবং চমকপ্রদো সব পর্যটন কেন্দ্রগুলো। এদিক দিয়ে এখানে প্রকৃতি তার অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে চলেছে অন্যদিকে মানুষ সৃষ্ট স্থাপনা গুলোও কোন দিক দিয়ে কম নয়।
এগেসকফ ক্যাসেল
এমন একটি অসাধারণ স্থাপনা হচ্ছে এগেসকফ ক্যাসেল। ১৪০৫ সালে নির্মিত রেনেসা যুগের এই ক্যাসেল ডেনমার্কের সবচেয়ে সুন্দর ক্যাসেল গুলোর মধ্যে একটি। ক্যাসেলটির ভেতরের অংশে আর্ট গ্যালারির পাশাপাশি একটি জাদুঘর ও রয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে অপূর্ব সুন্দর একটি বাগান, একটি গোলক ধাঁধা এবং জলাধার। টলটলে এই জলাধারে ক্যাসেলটির ছায়া পড়লে অপূর্ব সুন্দর এক এক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
ক্রনবর্গ ক্যাসেল
ক্রনবর্গ ক্যাসেল ও ডেনমার্কের অন্যতম সুন্দর একটি ক্যাসেল যা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। বিশাল এই ক্যাসেলটি হেলসিঙ্গর শহরে অবস্থিত, এই ক্যাসেলটির উপরে ভিত্তি করে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তার বিখ্যাত নাটক হ্যামলেট টি লিখেছিলেন। হেলসিঙ্গর শহরে অনেক স্থাপনা রয়েছে যেগুলো পর্যটকদের নিমিষেই মন ভুলিয়ে দিতে পারে। পুরো শহরটি জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মধ্যযুগীয় দূর্গ এবং গির্জা। মধ্যযুগীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনা গুলোর মাধ্যমে সে সময়কার চিহ্ন এবং ঐতিহ্য এখনো রয়ে গিয়েছে।
ড্রাগোর শহর
ইতিহাসে ঘেরা আরেকটি পুরাতন শহর ড্রাগোর যা এখনো সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। প্রায় হাজার বছরের পুরাতন এই শহরটির প্রধান আকর্ষণ অলিগলির ছোট ছোট রাস্তা এবং তার দুই পাশে রংবেরঙের ডেনিস ঘরবাড়ি।
বর্ণহোলম দ্বীপ
তবে দর্শনীয় স্থানের তালিকায় বর্ণহোলম দ্বীপ থাকবে না এমনটা হতে পারে না। বাল্টিক সাগরে অবস্থিত এই দ্বিপটি তার বৃত্তাকার গির্জার জন্য সুপরিচিত। বর্ণহোলম দ্বীপে মোট সাতটি বৃত্তাকার গির্জা রয়েছে যার প্রত্যেকটিই মনমুগ্ধকর। এছাড়াও দ্বীপটিতে রয়েছে পাথুরে উপকূল রেখা, বালুকাময় সৈকত, বন এবং হ্রদ যা বৈচিত্রময় প্রাকৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
ওয়াডেন সাগর
ওয়াডেন সাগর হল ডেনমার্কের এক প্রাকৃতিক বিষ্ময়। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে এর অপরূপ সৌন্দর্য আর বিরল প্রজাতির পাখিদের আবাসস্থলের জন্য। জোয়ারের সময় সৈকত গুলি প্লাবিত হলেও সেখানকার দৃশ্য অত্যন্ত সুন্দর। এই সাগরের অনেকগুলো দ্বীপ রয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর একটি দ্বীপ হলো ম্যানডো। সবুজ ঘাস এবং সাজানো এই দ্বীপটি এক চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার।
ফ্যারো আইল্যান্ডস
ডেনমার্কের সবচেয়ে সুন্দর ভ্রমণ স্থানের মধ্যে ফ্যারো আইল্যান্ডস অন্যতমযা চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এই আইল্যান্ডস এর প্রধান আকর্ষণ হল খাড়া উপকূলীয় ক্লিফ যা হাজার হাজার সামুদ্রিক পাখিকে আশ্রয় দেয়। ছুটি কাটাতে আসা পর্যটকেরা নীল সমুদ্রের উপরে এই ক্লিফগুলোর উপরে বসে পাখি দেখে আর এর বিস্ময়কর উপত্যকায় হাইকিং করে সময় কাটায়।
শেষ কথা
সবকিছু মিলিয়ে ডেনমার্ক যেন বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাজানো গোছানো শান্তিময় দেশ। এইজন্যেই তো দেশটি কারো কাছে রূপকথার মত আবার কারো কাছে সুখ এবং সমৃদ্ধির অপর নাম। ডেনমার্ক যেন এমন সুখ এবং শান্তির আধার হিসেবেই পৃথিবীর বুকে চিরকাল থাকুক এমনটাই প্রত্যাশা।
আমাদের ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন; প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url